সোমবার , ২৬ জুন ২০২৩, ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, রাত ১:১৮
আজকের সর্বশেষ সবখবর

মাদকাসক্তি প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন বিকল্প নেই- ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ 

ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ 
জুন ২৬, ২০২৩ ৩:৪৬ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

#২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সোমবার  (২৬ জুন) পালিত হচ্ছে বিশ্ব মাদক বিরোধী দিবস ২০২৩।মাদকের বিভীষিকাময় থাবা থেকে বাঁচতে এবং সবাইকে সচেতন করতে ২৬ জুন পালিত হয় বিশ্ব মাদকমুক্ত দিবস। এই দিবসটিকে আরো বলা হয় আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবস এবং ওষুধের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী দিবস। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৮৭ সালের ৪২তম অধিবেশনে পৃথিবীকে মাদকের ভয়বহ প্রভাব থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।পরের বছর থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে বিচরণ করছে সর্বনাশা মাদক। ঘুনে পোকার মত কুরে কুরে খাচ্ছে মানব অস্থিমজ্জা। অজগরের ন্যায় হামুখে খাওয়ার উপক্রম করছে গোটা মানব জাতিকে। এ ভয়ানক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব। অভিভাবকরা আতঙ্কিত, উৎকণ্ঠিত। তারা শংকিত কখন মাদকের স্রোতে দিক হারিয়ে নেশার জালে আটকা পড়ে যায় তাদের প্রিয় সন্তান। কখন ছোবল মেরে নেশাগ্রস্ত করে পাঠিয়ে দেয় মরণকূপে। এ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে নিজের সন্তানকে রক্ষার জন্য মা–বাবার সাথে পুরো জাতি আজ শংকিত, আতংকিত। মাদক এক জটিল সমস্যার নাম ‘ মাদকাসক্তি আধুনিক সভ্যতার ভয়ংকরতম ব্যাধিগুলোর অন্যতম। বিশ্বে অগণিত সফল জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, টেকনিশিয়ান ও অনুরূপ সফল মানুষের জীবন ও পরিবার ধ্বংস হয়েছে মদের কারণে। দিনে দিনে এই সমস্যা আরো প্রকট হয়ে উঠছে। একটা পরিবারে একজন সদস্য মাদকাসক্ত হয়ে পড়লেই সেই পরিবারে নেমে আসে বিভীষিকাময় পরিবেশ। মাদককে ঘিরে যেসব সমস্যা তৈরি হয় সেটা একটা পরিবারকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। মাদক সমস্যা পারিবারিক ক্ষেত্র থেকে ছড়িয়ে যায় সমাজের গন্ডিতে। শেষ পর্যন্ত সেটা রাষ্ট্রীয় সমস্যায় পরিণত হয়।
> মাদক কী?
মাদক এমন একটি দ্রব্য, যা খেলে নেশা হয়। গাঁজা, ফেনসিডিল, চরস, ভাং, গুল, জর্দা, হেরোইন, প্যাথেড্রিন, মদ, ইয়াবাসহ সবই মাদকের অন্তর্ভুক্ত। যখন কেউ এসব দ্রব্যাদির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখনই তাকে মাদকাসক্ত বলা হয়। ১৯৮৯ সালে প্রণীত বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মাদকাসক্ত বলতে, শারীরিক বা মানসিকভাবে মাদকদ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি বা অভ্যাসবশে মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারীকে বোঝানো হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা  এভাবে মাদকাসক্তির সংজ্ঞা দিয়েছে.মাদক ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ক্ষতিকারক এবং মাদকের বারবার সেবন দ্বারা উৎপাদিত হয় (প্রাকৃতিক এবং সিন্থেটিক।)
> কেন এই আসক্তি?
মানুষকে মাদকাসক্তির দিকে পরিচালিত করার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা, সামাজিক অস্থিরতা, উত্তেজনা, একঘেয়েমি, একাকিত্ব এবং পারিবারিক কাঠামো পরিবর্তনের পরিবেশে ব্যর্থতার সঙ্গে লড়াই করতে অক্ষমতা। তবে মাদকাসক্তদের সংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ হলো মাদকের সহজলভ্যতা।
দ্রুত নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যাপক উন্নয়ন এবং ইন্টারনেট ও তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, সামাজিক সচেতনতার অভাব ইত্যাদিও মাদকের সমস্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। পারিবারিক কলহ, ডিভোর্সের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবার, প্রেম ও চাকরিতে ব্যর্থতা থেকে হতাশার কারণেও মাদকাসক্তের হার বাড়ছে। বেশির ভাগ মাদক ব্যবহারকারী ‘পিয়ার প্রেশার’ বা বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়াকে প্রধান ‘পুল ফ্যাক্টর’ হিসেবে দোষারোপ করেছেন। প্রথমবারের মতো মাদক গ্রহণের জন্য কৌতূহল অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করে।
> ৩২ ধরনের মাদকঃ- দেশে বর্তমানে ৩২ ধরনের মাদক সেবন চলছে। এ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন নামের যেসব মাদক উদ্ধার হয়েছে সেগুলো হচ্ছে হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, কেডিন, ফেনসিডিল, তাড়ি, প্যাথেড্রিন, টিডি জেসিক, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড, ওয়াশ (জাওয়া), বনোজেসিক ইনজেকশন(বুপ্রেনরফিন),টেরাহাইড্রোবানাবিল, এক্সএলমুগের, মরফিন, ইয়াবা, আইএসপিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, মিথাইল, ইথানল ও কিটোন। এছাড়া ইনোকটিন, সিডাক্সিনসহ বিভিন্ন ঘুমের ট্যাবলেট, জামবাকসহ ব্যথানাশক ওষুধ কিংবা টিকটিকির লেজ পুড়িয়ে কেউ কেউ নেশা করে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
> মাদকাসক্তির বিভিন্ন কারণ চিহ্নিতঃ- ১. সমবয়সীদের চাপ, ২. হাতের কাছে মাদকদ্রব্য পাওয়া অর্থাৎ মাদকের সহজলভ্যতা, ৩. বেকারত্ব ও কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতা, ৪. আর্থসামাজিক অস্থিরতা, ৫. মাদকের কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা, ৬. সমাজে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, ৭. পারিবারিক কলহ, ৮. চিকিৎসা সৃষ্ট মাদকাসক্তি, ৯. কৌতূহল, ১০. ধূমপান ইত্যাদি।একটি কথা না বললেই নয় যে, মাদকের নাটের গুরু হচ্ছে সিগারেট। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মাদকাসক্তি ও ধূমপানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি মারাত্মক বলে উল্লেখ করেছে।তামাকের ধোঁয়ায় ৭ হাজার রাসায়নিক পদার্থ আছে, যার মধ্যে ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টি করে এবং এর একটি উপাদান মাদকের আওতায় পড়ে, সেটি হচ্ছে নিকোটিন। গবেষণায় দেখা যায়, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী। অর্থাৎ ধূমপান দিয়ে তারা তাদের নেশা শুরু করে। পরবর্তীকালে তারা গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন ও কোকেনে আসক্ত হয়।
> এক নজরে বাংলাদেশে মাদকের পরিসংখ্যানঃ- সমাজের ১৫-৩০ বছর বয়সীদের মাদকাসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। অধিদফতরের ২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১৬-৪০ বছর বয়সীদের প্রায় ৮৪ দশমিক ২৭ শতাংশ মাদকাসক্ত। এই বয়স সীমার মধ্যে ২১-২৫ বছর বয়সী যুবকরা রয়েছেন ‘সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে’। ১৬-২০ ও ২৬-৩০ বছর বয়সীরা ‘মধ্য ঝুঁকি’; ৩১-৩৫ বছর বয়সীরা রয়েছেন ‘স্বল্প ঝুঁকিতে’।বাংলাদেশে প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন মানুষ মাদকাসক্ত। দেশের বেকার জনসংখ্যারও বেশ বড় অংশ মাদকাসক্ত। মোট মাদকাসক্তদের ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত এবং ৪০ শতাংশ অশিক্ষিত। মাদকাসক্তদের প্রায় ৫৭ শতাংশ যৌন অপরাধী, যাদের ৭ শতাংশ হলো এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত। সারা দেশে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মাদক ব্যবসায়ী তাঁদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন, যাঁদের মধ্যে ২৭ হাজার ৩০০ জন মহিলা।
২০১৯ সালে গড়ে প্রতিদিন ১১৪ জন রোগী সরকারি ও বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১০৪ এবং ২০১৭ সালে ৬৯। এটাও অবাক করার মতো বিষয় যে ২০১৯ সালে মহিলা মাদকসেবীদের সংখ্যা চার গুণ বেড়েছে। ২০১৮ সালে ৯১ জন মহিলা সরকারি সুযোগ-সুবিধায় চিকিৎসা পেয়েছিলেন। এই সংখ্যা বেড়ে ২০১৯ সালে ৩৬০ হয়েছে।
র‌্যাবের সূত্রমতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৭৫ লাখ মাদকসেবী রয়েছে। মাদকসেবীদের শতকরা ৯১ ভাগই কিশোর ও তরুণ। এরমধ্যে ৪৫ দশমিক ৭৪ ভাগ বেকার, ৬৫ দশমিক ১ ভাগ আন্ডার গ্র্যাজুয়েট, ১৫ ভাগ উচ্চ শিক্ষার্থী, ২২ দশমিক ৬২ ভাগ ব্যবসায়ী, ১০ দশমিক ৬৭ ভাগ চাকরিজীবী, ৬ দশমিক ৬৭ ভাগ ছাত্র এবং ৬ দশমিক ৮০ ভাগ শ্রমিক। এর পেছনে ব্যয় হওয়া টাকার অংশও কম নয়। ৬০ লাখ মাদকসেবীর পেছনে খরচ করে ৯১,১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তন্মধ্যে কেবলমাত্র ফেনসিডিলই বছরে আমদানি হয় ১৭০০ কোটি টাকার, যা সীমান্ত পথে, যশোর, রাজশাহী, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, কুমিল্লা, আখাউড়া ও সিলেট হয়ে দেশে ঢুকছে। মাদকাসক্তির বহু কারণের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় অন্যতম। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতা, দারিদ্র্যের কষাঘাত, বেকারত্বের নৈরাশ্যও কম দায়ী নয়।আর ২০১৮ সালের ৩ মে থেকে  ২০২১ সালে ২০ জুন পর্যন্ত শুধু র‌্যাব সারাদেশ থেকে এক হাজার তিন কোটি ৭৭ লাখ টাকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। এই দুই বছরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৫১৭ জন মাদক কারবারিকে। হেরোইন উদ্ধার করা হয়েছে ৮৪ কেজি। এক কোটি ৫২ লাখ ২৩ হাজার ৬৭৩ পিস ইয়াবা বড়ি, দুই লাখ ৭৪ হাজার ৩০৩ বোতল ফেনসিডিল, আট হাজার ৫৫৪ কেজি গাঁজা, প্রায় দুই কেজি কোকেন, ছয় লাখ ৪৭ হাজার ২১৪টি নেশাজাতীয় ইনজেকশনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক উদ্ধার করা হয়।পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে সারাদেশে মাদক মামলা হয়েছে সাত হাজার ৬২৫টি। এপ্রিল মাসে এই মামলা কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৬৪০টিতে। মে মাসে মামলার সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৪৬৫টি। দেশের বেকার জনসংখ্যারও বেশ বড় অংশ মাদকাসক্ত। মোট মাদকাসক্তদের ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত এবং ৪০ শতাংশ অশিক্ষিত। মাদকাসক্তদের প্রায় ৫৭ শতাংশ যৌন অপরাধী, যাদের ৭ শতাংশ হলো এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত। সারা দেশে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মাদক ব্যবসায়ী তাঁদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন, যাঁদের মধ্যে ২৭ হাজার ৩০০ জন মহিলা। দেশে এত বিপুলসংখ্যক রোগীর জন্য নেই প্রয়োজনীয় হাসপাতাল বা নিরাময় কেন্দ্র। এদের চিকিৎসার জন্য দেশের ৪৪ জেলায় অনুমোদনপ্রাপ্ত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে ৩৫১টি। এর মধ্যে শতাধিক ঢাকায়। অনুমোদনপ্রাপ্ত কেন্দ্রগুলোর শয্যাসংখ্যা ৪ হাজার ৭২৮। এখানে মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা হৃদরোগসহ অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত কি না, তা নির্ণয়ের জন্য এক্স-রে, ইসিজিসহ নানা পরীক্ষার দরকার হয়। কিন্তু এসব পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই সেখানে।
বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এশিয়ার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ওয়েজ নামে পরিচিত মাদক চোরাচালানের তিনটি প্রধান অঞ্চলের কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরাও বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে সহজে ব্যবহার করতে পারছে। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের অন্তর্ভুক্ত মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে ছয়টি দেশের বাজার সামনে রেখে আইস উৎপাদন করছে, এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
পরিসংখ্যানে জানা যায়, দেশে গত তিন বছরে নারী ও শিশু মাদকাসক্ত বেড়েছে তিন গুণ। অপরিকল্পিত গর্ভপাতসহ বিভিন্ন কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন নারীরা। উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের মধ্যে এ নিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতা বাড়লেও, মধ্য ও নিম্নবিত্তের মধ্যে তা বাড়েনি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে এখনো অধিকাংশ মাদকাসক্ত নারী চিকিৎসার বাইরে। সূত্র থেকে জানা যায়, ‘আমাদের দেশে মাদকাসক্তদের ৮৪ ভাগ পুরুষ ১৬ ভাগ নারী এর মধ্যে ৮০ ভাগ তরুণ, ৬০ ভাগ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত, ৯৮ ভাগ ধূমপায়ী, ৫৭ ভাগ যৌন অপরাধী এবং ৭ শতাংশ নেশা গ্রহণকারী এইচআইভি আক্রান্ত। বাংলাদেশে বর্তমানে জনপ্রিয় নেশা ইয়াবা এবং এই ইয়াবা আসক্তদের ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী। ইয়াবা এমনই একটি ধ্বংসাত্মক মাদক যেটা গ্রহণ করলে সাময়িকউত্তেজনা বৃদ্ধি পেলেও চরম শারীরিক ও মানসিক অবসাদ হয় এবং সেটা থেকে চরম হতাশা, নৈরাজ্য ও বিষাদে পতিত হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে পারে এই ইয়াবা গ্রহণকারী।
সংবাদমাধ্যমে তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, গত ১০ বছরে নেশাখোর সন্তানের হাতে প্রায় ২০০ বাবা-মা খুন হয়েছেন, স্বামী হত্যা করেছে স্ত্রীকে, স্ত্রী হত্যা করেছে স্বামীকে। খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, পরকীয়া, দাম্পত্য কলহ, অর্থ লেনদেন, হত্যা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম সবকিছুর মূলেই রয়েছে এই মাদকের নেশা। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব কিন্তু সেই মানুষ মাদকের নেশায় হয়ে উঠে হিংস্র দানব, নরপশু। সড়ক দুর্ঘটনার ৩৩ ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী চালকের মাদক সেবন।দেশে ৩৬২ নিরাময় কেন্দ্রে বেড ৫০২৫ : ডিএনসি সদরদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার তেজগাঁওয়ে ১২৪ বেডের কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রসহ রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রামে রয়েছে ২৫ বেডের বিভাগীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। দেশের ৪৫টি জেলায় বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। ১৯টি জেলাতে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র নেই। সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে দেশের মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা ৩৬২টি- যেখানে মোট বেড সংখ্যা ৫ হাজার ২৫টি। এর মধ্যে বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রের বেড রয়েছে ৪ হাজার ৮৪৬টি।
এর মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৮১ নিরাময় কেন্দ্রে বেড রয়েছে ২ হাজার ৫৯৭, চট্টগ্রামে ৪৪ কেন্দ্রে ৫৬৫, খুলনায় ১৭ কেন্দ্রে ২১৫, রাজশাহীতে ৫৫ কেন্দ্রে ৬৪৮, বরিশালে ৮ কেন্দ্রে ১৮০, রংপুরে ১৭ কেন্দ্রে ২৩০, ময়মনসিংহে ২৪ কেন্দ্রে ২৮০ এবং সিলেটে ১২ কেন্দ্রে সবচেয়ে কম ১৩০টি বেড রয়েছে।
চিকিৎসা নিয়েছে ৩ লাখ মাদকাসক্ত : পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশে সরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাপ্রাপ্ত মাদকাসক্ত রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৮৫ হাজার ৪৩০ জন। আর বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা পাওয়া রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ২৯ হাজার ৪৯১ জন। সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে মোট চিকিৎসা নিয়েছে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৯২১ জন।
১৯ জেলায় নিরাময় কেন্দ্র নেই : ডিএনসির দেয়া তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, দেশের ১৯টি জেলায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কোনো মাদক নিরাময় কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। জেলাগুলো হলো- শরীয়তপুর, মাদারীপুর, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চাঁদপুর, নোয়াখালী, বাগেরহাট, মাগুরা, নড়াইল, মেহেরপুর, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, পঞ্চগড় ও লালমনিরহাট। আর বিভাগীয় পর্যায়ে সরকারিভাবে সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রংপুরে এখনো মাদক নিরাময় কেন্দ্র করা হয়নি।
নিরাময় কেন্দ্রে দেয়া হয় আর্থিক অনুদান : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের মান বাড়াতে নিয়মিতই দেয়া হচ্ছে আর্থিক অনুদান। ডিএনসির পক্ষ থেকে ২০১৯-২০১০ অর্থবছরে ৯১টি প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি টাকা, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১৩৭টি প্রতিষ্ঠানকে দেড় কোটি টাকা, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৪০ প্রতিষ্ঠানকে দেড় কোটি টাকা, সবশেষ ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৮২ প্রতিষ্ঠানকে আড়াই কোটি টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে।
কারিকুলাম প্রশিক্ষণ পেয়েছে ২২০৪ মাদকাসক্ত : মাদকাসক্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে কলম্বো প্ল্যানের আওতায় মাদকাসক্তি চিকিৎসা পাঠ্যক্রম বেসিক লেভেল কারিকুলামের ওপর ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৬০টি ব্যাচে ২২০৪ জন প্রশিক্ষণার্থীকে (মাদক নিরাময় চিকিৎসা নেয়া) প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল সার্টিফাইড এডিকশন প্রফেশনাল (আইক্যাপ-১) সনদ পেয়েছেন ৫২ জন।
> মাদক ব্যবহারে শরীরে স্বল্প মেয়াদী প্রতিক্রিয়া : মাদক রক্তচাপ কমায় এবং শ্বাস–প্রশ্বাসের মাত্রা হ্রাস করে। মাদক সেবনে ক্ষুধা ও যৌন অনুভূতি দ্রুত হ্রাস পায়। মতি বিভ্রম ঘটে এবং তার মধ্যে সন্ত্রস্ত ভাব দেখা যায়। শ্বাস–প্রশ্বাস ক্ষীণ থেকে ক্ষীনতর হয়। মাদকসেবী ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ এবং অবসন্ন হয়ে যায়। হূদস্পন্দন বৃদ্ধি পেলে রক্তচাপও বৃদ্ধি পায়। চলাফেরায় অসংলগ্নতা ধরা পড়ে। স্মৃতি শক্তি ও মনোযোগের ক্ষমতা সাময়িক হ্রাস পায়। তাই যে কোন মুহুর্তে জীবন বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। চোখ লালচে হয় এবং মুখ শুকিয়ে যায়। উগ্র মেজাজ, নিদ্র্র্রাহীনতা ও রাগান্বিত ভাব দেখা যায়। চামড়ায় ফুসকুড়ি, বমি বমি ভাব এবং নানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অধিক মাত্রায় মাদক সেবী মাতালের মতো আচরণ করে এবং হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে।
> মাদক ব্যবহারে শরীরে দীর্ঘ মেয়াদী প্রতিক্রিয়া : স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। এছাড়া মস্তিস্কে কোষের ক্ষয় প্রাপ্তি ঘটতে পারে। স্মৃতি শক্তি লোপ পায়। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান লোপ পায়। জীবনের সব বিষয় নিরাসক্ত হয়ে পড়ে। কোন কোন মাদকদ্রব্যে আসক্ত ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। মাদকাসক্ত মেয়েদের গর্ভের সন্তানের উপরও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে এবং সন্তানও মাদকাসক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
> মাদক ব্যবহারে কারণে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ঃ-
১. মাদক ব্যবহারে অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষতি .শ্বাস, প্রণালীতে ক্ষতি.খুসখুসে কাশি থেকে যক্ষা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, ক্যান্সার, শ্বাস–প্রশ্বাস ক্ষীণ হওয়া। ২.চোখের ক্ষতি : চোখের মনি সঙ্কুচিত হওয়া, দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া। ৩.লিভারের ক্ষতি : জন্ডিস, হেপাটাইটিস, সিরোসিস ও ক্যান্সার।৪. কিডনীর ক্ষতি : কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, ঘন ঘন সংক্রমণ হওয়া, পরিশেষে কিডনী অকার্যকর হয়ে যাওয়া, হূদযন্ত্রের কার্যকারীতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি। ৫. হূদযন্ত্র ও রক্ত প্রণালীতে ক্ষতি : হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া, হূদযন্ত্র বড় হয়ে যাওয়া, হূদযন্ত্রের কার্যকারীতা হ্রাস পাওয়া। ৬. রক্ত কণিকার সংখ্যায় পরিবর্তন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, রক্তস্বল্পতা ইত্যাদি। ৭.খাদ্য প্রণালীতে ক্ষতি: রুচি কমে যাওয়া, হজম শক্তি হ্রাস পাওয়া, আলসার, এসিডিটি, কোষ্ঠ কাঠিন্য, ক্যান্সার ইত্যাদি। ৮.ত্বকের ক্ষতি : ভিটামিন ও পুষ্টির অভাবে ত্বক হয়ে উঠে খসখসে শুস্ক। চুলকানী, ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হওয়া, ফোঁড়া, ঘা ইত্যাদি।৯. যৌন ক্ষমতা ও প্রজননের ক্ষতি : যৌন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, যৌন স্পৃহা কমে যাওয়া, বিকৃত শুক্র থেকে বিকৃত সন্তানের জন্ম, সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা। ১০.সিফিলিস, গনোরিয়া, এইডস ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হওয়া। মেয়েদের ক্ষেত্রে এ প্রভাব আরো মারাত্মক। গর্ভের সন্তান বিকৃত হয়ে যাওয়া, মৃত সন্তান প্রসব করা, জকোলীন শিশুর স্বল্প ওজন, জন্মের সাথে সাথেই নবজাতকের বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হওয়া। মস্তিস্ক ও স্নায়ুতন্ত্র এবং ১১.মানসিক ক্ষতি : নেশাগ্রস্ত অবস্থায় প্রলাপ বকা, আত্মহত্যার প্রবণতা, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে অসচেতনতা, মাথা ঘুরানো, চিন্তা শক্তি লোপ পাওয়া, অমনোযোগিতা, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, অস্থিরতা ও অধৈর্য অবস্থা, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, উদ্বেগ, ভয় পাওয়া, বিষন্নতা ইত্যাদি মানসিক রোগ দেখা দেয় অনেক ক্ষেত্রে।
> মাদকসেবীদের চিহ্নিত করার উপায় : মাদকসেবীদের চিহ্নিত করার স্বাভাবিক লক্ষণগুলো হলো চোখে সাধারণ আকৃতির চেয়ে বড় করে তাকানো। হঠাৎ স্বাস্থ্যহানী বা আকস্মিক স্বাস্থ্যবান হয়ে যাওয়া। চোখ ও মুখ ফোলা এবং চোখ লালচে হওয়া। সামান্য বিষয়ে অতিরিক্ত রেগে যাওয়া। অধিক রাত করে ঘুমানো এবং বিলম্বে ঘুম থেকে উঠা। একাকী অন্ধকার নির্জন রশুমে সময় কাটানো। উদাসী–উদাসী ভাব এবং সবকিছুতে ভুল করা। নিকটাত্মীয় এবং পরিবার পরিজনদের সাহচর্য এড়িয়ে চলা। সব বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা, হীনমন্যতায় ভোগা। বিষন্ন খেয়ালে ভাবনার গভীর অন্তরালে কিছু খোজাঁ। বেশী বেশী টাকা ব্যয় করা এবং অভিভাবকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা আদায় করা। কখনো খাদ্যের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া আবার কখনো হ্রাস পাওয়া। নিজের শরীর স্বাস্থ্য ও পোশাকের প্রতি খেয়ালহীনতা ইত্যাদি সাধারণ কারণ, যা সহজেই ধরা পড়তে পারে।
পারিবারিক কর্তব্য : পারিবারিক ভাবে মাদক বা ড্রাগসেবীদের চিহ্নিত করতে পারলে, তাদের উচিৎ কাজ হলো– মাদকে আসক্তির মূল কারণ খুঁজে বের করা। প্রেম ঘটিত কোন কারণ হলে এর সুস্থ সুন্দর সমাধান দেওয়া। মানসিক পারিবারিক চাপ প্রয়োগ না করে তাকে ভালবাসা ও স্নেহের বন্ধনে আরো নৈকট্যে নিয়ে আসা। পরিবারের কেউ অন্ততঃ তার খুব কাছাকাছি হওয়া এবং বন্ধুত্বের সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া। সর্বোপরি তাকে বুঝিয়ে মাদক সেবন থেকে দূরে থাকতে সহায়তা করা।
> মাদক সেবনে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ গুলোঃ-মাদক জীবন থেকে জীবন কেড়ে নেয়। মাদক সেবন ভীষণ ক্ষতিকর। একজন মানুষের ব্যক্তি জীবন এবং সামাজিক জীবনকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এটি। নিয়মিত মাদক সেবনের ফলে ব্যক্তির মেজাজ-মর্জি, বিচার-বিবেচনা এবং নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা, আবেগের উচ্চমাত্রা পরিবর্তন প্রভৃতি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যার কারণে ব্যক্তিগত সমস্যার পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি হয়। আসুন জেনে নেই মাদক সেবনে কী কী মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি হয়।* সম্পর্কের অবনতিঃ-নিয়মিত মাদক সেবনের ফলে ব্যক্তির মেজাজ দ্রুত পরিবর্তিত হয়। ফলে তারা অল্পতেই বিরক্ত হয় এবং রেগে যায়। যার কারণে অন্যদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি হয় এমনকি কারো কারো সাথে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশে প্রায়ই শোনা যায় মাদকসেবীদের হাতে পরিবারের সদস্যরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।  * বিচার-বিবেচনা লোপ পায়ঃ- নিয়মিত মাদক সেবনের ফলে ব্যক্তির সুস্থ চিন্তা-চেতনা সম্পূর্ণ লোপ পায়। যার কারণে কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতি কিংবা কোনো বিষয়ে সঠিক বিচার-বিবেচনা, মূল্যায়ন কিংবা বিশ্লেষণ এবং অনুধাবন করার ক্ষমতা স্বাভাবিক থাকে না।* সিদ্ধান্ত হীনতাঃ-মাদক গ্রহণের ফলে ব্যক্তির সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়। বিচার-বিবেচনা লোপ পাওয়ায় সঠিক সিদ্ধান্তটি সঠিক সময়ে নিতে পারে না তারা। যেকোনো বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং আত্মমর্যাদাবোধ বিলুপ্ত হয়।* আসক্তিঃ-যারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে তারা নিজের পরিবারের জন্য যেমন একটি মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তৈরি করে একই সাথে অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে ওই পরিবারগুলোকে দারুণভাবে ক্ষতির মধ্যে ফেলে দেয়। সমাজের বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে এরা সহজে জড়িয়ে পড়ে।* আত্মনিয়ন্ত্রণ হারানোঃ-মাদকাসক্ত ব্যক্তির নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যদিও সে বুঝতে পারে যে কাজটি করছে তা অন্যায় হচ্ছে তবুও সে নিজেকে অন্যায় থেকে নিবৃত করতে পারে না। আর ধীরে ধীরে তার অন্যায়ের মাত্রা বাড়তে থাকে, তবুও সে নিজেকে অন্যায়ের পথ থেকে ফেরাতে পারে না।
* উদ্বিগ্নঃ-নিয়মিত মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বদা একটা উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা বিরাজ করে। তাদের মন-মানসিকতা দ্রুত পরিবর্তিত হয়। যেমন : এই খুব উৎফুল্ল আবার এই খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ফলে কোনো কাজ একাগ্রচিত্তে করতে পারে না।* কাজে আনন্দ লোপ পাওয়াঃ-মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তি কোন কাজে উৎসাহ পায় না। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার আনন্দ আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকে। আর কোনো কাজ করেই তখন সে আর আনন্দ বা আগ্রহ পায় না।* বিপজ্জনক কাজে জড়িয়ে পড়েঃ-মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তি ক্রমান্বয়ে মারাত্মক বিপজ্জনক কাজ করতে শুরু করে। যেমন: রাস্তায় বেপড়োয়া গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন অমান্য প্রভৃতি কাজগুলো দিন দিন বেড়ে যাবে। যার ফলে সড়ক দুর্ঘটনা, অকাল মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে থাকে।
পরিশেষে বলতে চাই, সীমান্তে মাদক-চোরাচালান রোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও তৎপর, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। কারণ আমাদের দেশ মাদক-চোরাচালানের রুটগুলোর মাঝামাঝি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের (১৯৯০) ধারাগুলো সময়োপযোগী করে এর যথাযথ প্রয়োগ ও কঠোর বাস্তবায়ন করা গেলে মাদকের অপব্যবহার অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। মাদক-ব্যবসায়ী ও চোরাচালানকারীরা দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু । এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। মাদকব্যবহারের ধ্বংসাত্বক প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাদকের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে মাদকমুক্ত সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার কোনও বিকল্প নেই।তাই আসুন, আমরা সবাই মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে সাহায্য করি, তাদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাব্যবস্থার সুযোগ করে দিই। তাহলেই তারা সমাজের বোঝা না হয়ে বরং সুস্থ হয়ে পরিবারে ফিরে আসবে, তারাই সমাজকে সঠিকপথে পরিচালিত করবে।মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় ২৬ জুনকে মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরের বছর থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
 বিশ্ব মাদকমুক্ত দিবসে আজকের দিনে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক,
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
কলাম লেখক ও গবেষক
ইমেইল, drmazed96@gmail.com

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।