রমজানে চার শ্রেণির নারীর রমজান মাসে রোজা না রেখে পরবর্তীতে কাজা করার সুযোগ আছে। তারা হলেন-
১. অন্তঃসত্ত্বা নারী রোজা রাখলে যদি তার নিজের বা গর্ভস্থ সন্তানের সমূহক্ষতির আশঙ্কা থাকে তবে পরে কাজা আদায় করতে পারবেন। গাইনি চিকিৎসকরা বলেন, গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ ক্যালরির প্রয়োজন হয়। তাই একজন গর্ভবতী মাকে দিনে ছয় বার বা তারও বেশি খেতে বলা হয়। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য কষ্টকর ব্যাপার। তাছাড়া গরমে গর্ভবতী মা প্রচুর ঘেমে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতায় ভুগতে পারেন। এমনকি অনাগত শিশুটি অপুষ্টি ও কম ওজন নিয়ে জন্মানো কিংবা মায়ের মূত্রনালির ইনফেকশনের আশঙ্কা থাকে।
তবে পরবর্তীতে সুস্থ অবস্থায় তা কাজা করে নিতে হবে। কিন্তু রোজা রাখার দ্বারা যদি স্বাস্থ্যের ওপর কোনও প্রভাব না পড়ে এবং সন্তানের জন্যও আশঙ্কাজনক কোনও অবস্থা তৈরি না হয় তাহলে তিনি রোজা রাখবেন। এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে ধর্মীয় বিধানের গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বিনা কারণে বা সামান্য অজুহাতে ফরজ রোজা ছাড়া যাবে না। তবে পরবর্তী সুস্থতার সময় তা শুধু কাজা করতে হবে। কাফফারা আদায় করতে হবে না। (ফাতহুল কাদির : ২/২৭২, রদ্দুল মুহতার : ২/২০২)।
২. দুগ্ধদানকারী নারীর বিধানও অন্তঃসত্ত্বা নারীর অনুরূপ। স্তন্যদাত্রী নারী রোজা পালনের ফলে নিজের বা দুগ্ধপোষ্য শিশুর স্বাস্থ্যহানি বা অঙ্গহানির সম্ভাবনা থাকলে পরবর্তীতে কাজা আদায় করার শর্তে রোজা ছাড়তে পারবেন। এই মর্মে সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী নারী রমজানের রোজা ভাঙতে পারবেন। তবে পরে তা কাজা করে নেবেন। রোজার পরিবর্তে রোজা না রেখে ফিদইয়া হিসেবে মিসকিনদের খাওয়াবেন না। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদিস : ৭৫৬৪)।
৩. মাসিক বা ঋতুবতী নারী ও
৪. সন্তান প্রসব পরবর্তী সময়ে নির্দিষ্ট দিনগুলোতে নারীদের ওপর রোজার বিধান স্থগিত থাকবে। পবিত্র এবং সুস্থ হওয়ার পর উক্ত দিনগুলোর রোজা কাজা আদায় করে নিতে হবে।
উল্লেখ্য, হায়েজ ও নেফাসগ্রস্ত নারী রোজা রাখলেও তা আদায় হবে না। পক্ষান্তরে অন্তঃসত্ত্বা ও দুগ্ধদানকারী নারী রোজা রাখলে রোজা আদায় হয়ে যাবে। অর্থাৎ রমজান মাসে হায়েজ এবং নেফাস ছাড়া অন্যান্য সমস্যাগ্রস্ত নারীদের জন্য রোজা না রাখা ঐচ্ছিক বিধান হলেও হায়েজ এবং নেফাসগ্রস্থ নারীদের জন্য রোযা না রাখা বাধ্যতামূলক বিধান।
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে আমরা পবিত্র হলে তিনি আমাদের রোজা কাজা করার নির্দেশ দিতেন। কিন্তু নামাজ কাজা করার নির্দেশ দিতেন না। (বুখারি, মুসলিম, জামে আত-তিরমিজি, হাদিস নং-৭৮৭)।
বাচ্চা প্রসবের সময় ও তার পরবর্তীতে নারীদের গর্ভাশয় থেকে যে রক্ত নির্গত হয় তাই নেফাসের রক্ত। সাধারণ প্রক্রিয়ায় সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে গর্ভাশয় থেকে বেশ কিছু দিন রক্তস্রাব প্রবাহিত হয়। এটি নারীদের শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে কম বা বেশি হয়। এর সর্বনিম্ন মেয়াদ একদিনও হতে পারে। আর সর্বোচ্চ মেয়াদ ৪০ দিন।
মাসয়ালা: গলার ভেতরে প্রবেশ না করার শর্তে খাবারের স্বাদ বোঝার জন্য জিহ্বার অগ্রভাগে নিয়ে স্বাদ আস্বাদন করতে পারবেন স্ত্রীরা। একইভাবে ছোট শিশুর জন্য শক্ত খাবার মুখে নিয়ে দাঁত দিয়ে ভেঙে নরম করে দিতে পারবেন। এতে রোজার কোনও ক্ষতি হবে না। তবে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এমন না করাই উত্তম। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, গলার ভেতরে প্রবেশ না করলে তরকারির ঝোল বা অন্য কিছুর স্বাদ আস্বাদন করতে কোনও সমস্যা নেই। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা : হাদিস নং-৯২৭৭, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : হাদিস নং-৭৫১১)।
ফিদইয়ার মাসয়ালা: ফিদইয়া আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো, মুক্তিপণ বা বিনিময়। ফিদইয়া প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, ‘এটা (রোজা) যাদের অতিশয় পীড়া দেয় তাদের কর্তব্য। এর পরিবর্তে ‘ফিদইয়া’ মানে একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎ কাজ করে, তবে সেটা তার পক্ষে অধিকতর কল্যাণকর। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে তবে বুঝতে সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণপ্রসূ।’ (সুরা বাকারা : ১৮৪)।
ইসলামের বিধান পালন করা হয় মানুষের নিজেদের স্বার্থে বা নিজেদের উপকারার্থে; এতে আল্লাহ তায়ালার লাভ, স্বার্থ বা উপকার নেই। সুতরাং আল্লাহ তা’আলা মানুষের কল্যাণের জন্য বিধান দিয়েছেন মানুষেরই সামর্থ্য অনুযায়ী। আল্লাহ তা’আলা বলেন: ‘আল্লাহ কোনও ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের অধিক দায়িত্ব চাপান না।’ (সুরা-বাকারা : আয়াত: ২৮৬)।
মাসয়ালা: রোজার ফিদইয়া জাকাত ও সদকা প্রদানের খাতসমূহে দেওয়া যাবে। এক দিনের ফিদইয়া একাধিক ব্যক্তির মাঝে বণ্টন করে দেওয়া যাবে। আবার একাধিক দিনের ফিদইয়া এক ব্যক্তিকেও দেওয়া যাবে। কয়েক দিনের রোজার ফিদইয়া একত্রেও আদায় করা যায় এবং অগ্রিমও আদায় করা যায়। যাকে ফিদইয়া দেওয়া হবে তার রোজাদার হওয়া জরুরি নয়। যেমন: নাবালক মিসকিন শিশু বা অতিবৃদ্ধ দুর্বল অক্ষম অসুস্থ অসহায় গরিব ব্যক্তি, যিনি নিজেও রোজা পালন করতে পারছেন না। রোজা শারীরিক ইবাদত। আর কোনও শারীরিক ইবাদত একজন আরেকজনেরটি আদায় করতে পারে না। নিজের রোজা নিজেকেই রাখতে হবে। অন্য কেউ রাখলে, আদায় হবে না। তাই ফিদইয়া রোজার পরিবর্তে রোজা নয়; ফিদইয়া হলো রোজার পরিবর্তে খাদ্য বা টাকা প্রদান করা। (ফতোয়ায়ে শামি : ২/৪০২, ফতোয়ায়ে দারুল উলুম : ৬/৪২২)।